লেখক: নূর হোসেন মাজিদী
পর্ব ১- এ সৃষ্টিলোকের কেন্দ্রবিন্দু হযরত রাসূল আকরাম (সাঃ)। আল্লাহ তা’আলা প্রথমেই রাসূলে আকরামের (সাঃ) নূর সৃষ্টি করেন এবং সৃষ্টিকর্মের এক পর্যায়ে সকল নবী রাসূলের (আঃ) রূহ (আত্মা) সৃষ্টি করেন অর্থাৎ পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয়ার বহু পূর্বেই তাঁদেরকে নবী হিসাবে মনোনীত করা হয়। কিন্তু অন্যান্য নবী রাসূলগণের রূহ সৃষ্টির বহু পূর্বেই আল্লাহ্ তা’আলা হযরত রাসূলে আকরাম মুহাম্মাদ (সাঃ) এর নূর সৃষ্টি করার পর আরও কয়েকজনের নূরানী সত্তা সৃষ্টি করেন। তাঁরা হচ্ছেন হযরত ফাতেমা, হযরত আলী, হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)। এঁদের সম্পর্কে বিভিন্ন ইসলামী সূত্রেই শুধু নয়, ইসলাম-পূর্ব যুগের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থেও বিভিন্নভাবে উল্লিখিত হয়েছে।
হাদীসে রাসূলে আকরাম (সাঃ) ও পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবের সাক্ষ্য থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, হযরত ফাতেমা যাহরা (আঃ) হচ্ছেন একমাত্র নারী যাঁকে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর সৃষ্টিকর্মের প্রথম পর্যায়েই নূর আকারে সৃষ্টি করে পবিত্র নুরে মুহাম্মদী (সাঃ) এর পাশে স্থান দান করেন এবং হযরত আদম (আঃ) এর তওবাহ্ কবুলের জন্য অন্যতম ওয়াসিলাহ্ স্বরূপ করেন।
এছাড়া বোখারী, তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ, মুস্তাদরাকে হাকেম এবং আরও অনেক হাদীস গ্রন্থে ও বহু তাফসীর গ্রন্থে হযরত নবী করীম (সাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত করা হয়েছে যাতে হযরত ফাতেমাকে (আঃ) “মু’মিন নারীদের নেত্রী”, “উম্মাতে মুহাম্মাদীর নারীদের নেত্রী”, “জগতসমূহের নারীদের নেত্রী” ও “বেহেশতে নারীদের নেত্রী” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেছেন যে, নারীকুলের মধ্যে চারজন মহিলা সকলের শ্রেষ্ঠ, তাঁরা হচ্ছেন হযরত মরিয়ম (আঃ), হযরত আসিয়াহ (আঃ), হযরত খাদীজাহ্ (আঃ) ও হযরত ফাতেমা (আঃ) এবং এদের মধ্যে হযরত ফাতেমা (আঃ) এর মর্যাদা সকলের ওপরে।
শুধু তাই নয়, সমগ্র মানবকুলের মধ্যে সর্বপ্রথম যিনি বেহেশতে প্রবেশ করবেন তিনি হচ্ছেন হযরত ফাতেমা যাহরা (আঃ)। এ প্রসঙ্গে বুখারী, মুসনাদে আহমাদ, তাবাকাতে ইবনে সা’দ প্রভৃতি বিভিন্ন গ্রন্থে নবী করীম (সাঃ) থেকে হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। বলা বাহুল্য, এসব হাদীসে হযরত ফাতেমা (আঃ)কে নারীকুলের মধ্যে সর্বপ্রথম বেহেশতে প্রবেশকারিণী হবেন বলে উল্লেখ করা হয় নি, বরং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম তিনিই বেহেশতে প্রবেশ করবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে আল্লাহ্ তা’আলা হযরত ফাতেমা (আঃ) এর মাধ্যমে সমগ্র নারীকুলকে এক ব্যতিক্রমধর্মী মর্যাদার অধিকারী করেছেন।
হযরত ফাতেমা (আঃ) এর মর্যাদা আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকেই নির্ধারিত ছিল। আল্লাহ্ তা’আলা হযরত ফাতেমা (আঃ), হযরত আলী (আঃ), হযরত ইমাম হাসান (আঃ) ও হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) কে হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর আহলে বাইতের মর্যাদা দিয়েছেন। হযরত নবী করীম (সাঃ) এর স্ত্রীগণও এ মর্যাদা লাভ করেন নি।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, “আহলে বাইত” এর মানে “গৃহবাসিগণ” অর্থাৎ পরিবারের সদস্যগণ। সে অর্থে নবী করীম (সাঃ) এর স্ত্রীগণ অবশ্যই তাঁর আহলে বাইতের অন্তর্ভূক্ত ঠিক যেভাবে অন্য যেকোন ব্যক্তির স্ত্রীই তার আহলে বাইত বা পরিবারের সদস্য। এটা হচ্ছে আভিধানিক তাৎপর্য। কিন্তু কুরআন মজীদে “আহলে বাইত” একটি পরিভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে যা পূর্ববর্তী অন্য কোন পরিবার সম্পর্কে প্রযোজ্য নয়। এতে ব্যক্তি হিসাবে নয়, নবী হিসাবে হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর আহলে বাইতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যার সদস্যগণ বিশেষভাবে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে মনোনীত এবং যারা পাপ পঙ্কিলতা থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিলেন।
সূরাহ্ আহ্যাবের ৩৩নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে, “হে আহলে বাইত! নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তোমাদের থেকে অপকৃষ্টতা ও অপরিচ্ছন্নতাকে দূরীভূত করে দিতে এবং তোমাদেরকে পরিপূর্ণরূপে পবিত্র করে দিতে চান।”
ইসলামী উম্মাহর সকল মাযহাবের অভিন্ন মত হচ্ছে এই যে, এ আয়াতে “আহলে বাইত” বলতে হযরত ফাতেমা (আঃ), হযরত আলী (আঃ), হযরত ইমাম হাসান (আঃ) ও হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)কে বোঝানো হয়েছে। এ ইজমা’র পেছনে ইসলামের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার অবদান রয়েছে। তা হচ্ছে নাজরানের খৃস্টানদের সাথে মুবাহালার ঘটনা। নবী করীম (সাঃ) এর নবুওয়াতের সত্যতা সম্বন্ধে নিশ্চিতভাবে জানা সত্ত্বেও নাজরানের খৃস্টান ধর্মনেতারা তাঁর বিরুদ্ধে নানা রকমের বিভ্রানি- ছড়াচ্ছিল। এমতাবস্থায় তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে নির্দেশ আসে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেনঃ “(হে রাসূল!) তোমার কাছে অকাট্য জ্ঞান এসে যাওয়ার পরেও যে তোমার সাথে এ ব্যাপারে ঝগড়ায় অবতীর্ণ হয় তাকে বলে দাও : আসো, আমরা আমাদের পুত্রদের ও তোমাদের পুত্রদের, আমাদের নারীদের ও তোমাদের নারীদের এবং আমাদের নিজেদের ও তোমাদের নিজেদের আহবান করি, অতঃপর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যাতে মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হয়।” (আলে ইমরানঃ ৬১)